জুলাইয়ে হত্যাকাণ্ড: মারণাস্ত্র ব্যবহার ৫০ জেলায়

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ০১ অক্টোবর ২০২৫, ০৯:০৩

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার ওপর আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বেশি ঘটেছে দেশের ৪১ জেলার ৪৩৮ স্থানে। ৫০-এরও বেশি জেলায় ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও হত্যায় ব্যবহৃত হয়েছে মারণাস্ত্র (লেথাল উইপন)। মঙ্গলবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর এসব তথ্য উল্লেখ করেন। এ সময় ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শিত আলজাজিরার একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরে বলা হয়, সাবেক এনটিএমসি’র মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান শেখ হাসিনার দেওয়া একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত করতেন। পরে র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের তুলে নিয়ে নির্যাতন করতেন। শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম হওয়া বেশিরভাগ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। আলামত গায়েবের অংশ হিসাবে হত্যার পর অনেকের লাশ সিমেন্টের ব্যাগ বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো।
অপরদিকে বিবিসির প্রতিবেদনের বরাতে বলা হয়, একটি নথির তথ্য মতে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ২৪৪৪ রাউন্ড গুলিবর্ষণ করেছে। এরমধ্যে ৬৯৫টি এসএমজির গুলি।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে সাক্ষ্য পেশ করেন তিনি।
তদন্ত কর্মকর্তাকে জেরার জন্য আগামী সোমবার দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন-বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। এদিন বিচার কার্যক্রম বিটিভিতে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
এদিন বেলা সাড়ে ১১টায় তৃতীয় দিনের মতো ৫৪তম সাক্ষী হিসাবে আলমগীরের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। জবানবন্দির একপর্যায়ে তিনি বলেন, গত বছরের জুলাই আন্দোলন চলাকালীন ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্থানে হত্যাকাণ্ড হয়েছে। ৫০টিরও বেশি জেলায় মারণাস্ত্র ব্যবহার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই আন্দোলনকারীদের সবাই সাধারণ নিরীহ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা এনটিএমসি’র মতো প্রতিষ্ঠান মোবাইল ট্র্যাকিং করে আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করে।
এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘জুলাইয়ে হত্যাকাণ্ড বা নৃশংসতা চলল, এসব বন্ধে আসামিরা কোনো পদক্ষেপ নিয়েছিলেন কিনা। আপনি তদন্তে কী পেয়েছেন?’ জবাবে সাক্ষী আলমগীর বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড-নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য আসামিরা কোনো পদক্ষেপ নেননি। একইসঙ্গে যারা হত্যা-গুম-জখম করেছেন, তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। মূলত জুলাই আন্দোলনসহ গত ১৫ বছরে খুন-গুম, নির্যাতনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা।’
মঙ্গলবার জব্দকৃত বিভিন্ন তথ্য ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর। তিনি জুলাই আন্দোলনে পুলিশের চালানো হত্যাযজ্ঞ নিয়ে বিবিসি ও আলজাজিরাতে প্রচারিত দুটি প্রতিবেদন জমা দেন। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় মিরাজ নামে এক শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে মারা যান। মিরাজের ভাই পাভেল প্রতিবেদনে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ৪ আগস্ট সন্ধ্যায় গণভবনে জরুরি বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় ৫ আগস্ট গণভবন ঘেরাও কর্মসূচি যেন সফল না হয়। আন্দোলনকারীরা যেন ঢাকায় ঢুকতে না পারে, সেই জন্য সবগুলো প্রবেশমুখে পুলিশের ব্যারিকেড দেওয়ার নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা। ৫ আগস্ট সকালে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে ঢাকায় প্রবেশ করতে থাকে। এতে যোগ দেয় মিরাজ ও তার বন্ধু শাওন আল মাহমুদ। এদিন দুপুর ১টা ২৬ মিনিটের সময় যাত্রাবাড়ী টোলপ্লাজা এলাকায় পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে আন্দোলনকারীরা ঢাকার দিকে ঢুকতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার ভেতর থেকে পুলিশ গুলি ছুড়তে ছুড়তে বের হয়ে আসে।
প্রতিবেদনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শাওন আল মাহমুদ জানান, বেলা ২টা ২৫ মিনিটের দিকে খবর পান শেখ হাসিনা সামরিক বিমানে পালিয়ে গেছেন। এ খবরে যাত্রাবাড়ী এলাকায় আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি হয়। এ সময় তারা যাত্রাবাড়ী থানার সামনে যান। মিরাজ তখন ভিডিও করছিল। ছাত্র-জনতা থানার সামনে অবস্থান করলে সেনাবাহিনী এসে সামনে দাঁড়ায় এবং আন্দোলনকারীদের সমর্থন জানায়। এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী চলে গেলে বেলা ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে পুলিশ পুনরায় গুলি করতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে মিরাজ এবং আমি আলাদা হয়ে যাই। পরে খবর পাই মিরাজ মারা গেছে। আলজাজিরার প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের কলরেকর্ড পাওয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়। তাতে বলা হয়, তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ফোন করে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ হত্যার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন চান সালমান এফ রহমান। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরির বিলম্বের কারণ জানতে চান তিনি। প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ এক কর্মকর্তা সাক্ষাৎকারে জানান, শেখ হাসিনা বলেছিলেন আবু সাঈদের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তন করতে হবে। তখন টেম্পারিং করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছিল। ওই কর্মকর্তা জানান, জাতীয় সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) তদানীন্তন মহাপরিচালক ছিলেন জিয়াউল আহসান। তিনি একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান শনাক্ত করতেন এবং তুলে নিতেন। শেখ হাসিনার আমলে গুম হওয়া বেশিরভাগ ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। এরপর মরদেহ সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো।
আলজাজিরার প্রতিবেদনে ওঠে আসে, শেখ হাসিনা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নুর তাপসের কথোপকথন। সেখানে শেখ হাসিনা তাপসকে বলেন, আন্দোলন দমনে ‘লেথাল উইপন’ (প্রাণঘাতী অস্ত্র) ব্যবহার করা হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে মাঠে নামার নির্দেশনা দেন। রংপুরে শহীদ আবু সাঈদের পরিবারকে ভুল বুঝিয়ে গণভবনে আনা হয়েছিল। আবু সাঈদের বোন সাক্ষাৎকারে বলেন, আমাদের হাতে কিছু সঞ্চয়পত্র দেওয়া হয় সেখানে। বিষয়টি মীমাংসা হয়ে গেছে-এমনটি বোঝাতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। আবু সাঈদ হত্যার ঘটনাটি তদন্ত হবে বলে জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তখন আমি বলেছিলাম ‘আবার তদন্ত কেন, কারা মেরেছে তা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে।’ ঢাকার মোহাম্মদপুরে শহীদ মাহামুদুর রহমানের বোন (সৈকত) সাবরিনা আফরোজ সেবন্তীর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয় আলজাজিরা টেলিভিশনে। সেটিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়। সাবরিনা আফরোজ সেখানে বলেন, তার ভাই মাহামুদুর রহমান গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯ জুলাই বিকালে পুলিশ খুব কাছ থেকে তার ভাইকে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার পর শেখ হাসিনা তাকে গণভবনে ডেকেছিলেন ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য। তিনি তাতে রাজি হননি। এছাড়া আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী নাফিসা হোসেন মারওয়ার বাবা আবুল হোসেনের একটি সাক্ষাৎকার তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। নাফিসাকে ৫ আগস্ট হত্যা করা হয়।